আইপি ঠিকানা হচ্ছে ডোমেইন নেম এর গাণিতিক রূপ ব্যাখ্যাঃ ইন্টারনেটে প্রতিদিন আমরা যখন google.com, facebook.com বা youtube.com-এর মতো ওয়েবসাইটের নাম লিখি, তখন আমরা আসলে একটি সুন্দর, মানুষের মনে রাখা সহজ নাম ব্যবহার করি। এই নামগুলোকে বলা হয় ডোমেইন নেম। কিন্তু কম্পিউটার বা ইন্টারনেটের নেটওয়ার্ক আসলে এই নাম বোঝে না। তারা শুধু সংখ্যা বোঝে। আর সেই সংখ্যার রূপই হলো আইপি ঠিকানা (IP Address)।উদাহরণস্বরূপ, আপনি যদি ব্রাউজারে “google.com” লেখেন, তাহলে আপনার কম্পিউটার পর্দার আড়ালে খুব দ্রুত একটি কাজ করে—সেটি google.com-এর সাথে যুক্ত আইপি ঠিকানা খুঁজে বের করে। বর্তমানে (ডিসেম্বর ২০২৫ অনুযায়ী) google.com-এর একটি প্রধান আইপি ঠিকানা হলো 142.250.190.78 (IPv4) অথবা 2607:f8b0:4004:831::200e (IPv6)। এই সংখ্যাগুলো দেখে মনে হতে পারে জটিল, কিন্তু আসলে এটিই ইন্টারনেটের প্রকৃত ভাষা। এই আর্টিকেলে আমরা খুব সহজ ভাষায় বোঝাবো: ডোমেইন নেম কী এবং কেন এটি দরকার,আইপি ঠিকানা আসলে কী এবং কেন এটি গাণিতিক,কীভাবে একটি ডোমেইন নেম থেকে আইপি ঠিকানায় রূপান্তর হয় (DNS-এর মাধ্যমে),IPv4 এবং IPv6-এর পার্থক্য,বাস্তব জীবনে এগুলো কীভাবে কাজ করে সহ নানান বিষয় নিয়ে। চলুন শুরু করা যাক।
ডোমেইন নেম হলো ইন্টারনেটে কোনো ওয়েবসাইটের মানুষের পড়া ও মনে রাখা সহজ নাম। যেমন: wikipedia.org, prothomalo.com, bdjobs.com ইত্যাদি।একটি ডোমেইন নেম সাধারণত তিনটি অংশে বিভক্ত থাকে:
মানুষের জন্য google.com মনে রাখা খুব সহজ। কিন্তু যদি আমাদের প্রতিটি ওয়েবসাইটের জন্য ১০-১২ সংখ্যার আইপি ঠিকানা মুখস্থ করতে হতো, তাহলে ইন্টারনেট ব্যবহার করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যেত। তাই ডোমেইন নেম হলো একটা উপনাম বা ডাকনাম যা আমাদের জীবন সহজ করে দেয়।
আইপি ঠিকানা (Internet Protocol Address) হলো ইন্টারনেটে প্রতিটি ডিভাইসের একটি অনন্য সংখ্যাসূচক ঠিকানা। এটি যেন ডাক বিভাগের জন্য বাড়ির ঠিকানা—যাতে ডেটা প্যাকেট সঠিক জায়গায় পৌঁছাতে পারে।
বর্তমানে দুই ধরনের আইপি ঠিকানা বেশি ব্যবহৃত হয়:
IPv4-এ মোট ৪৩০ কোটিরও বেশি ঠিকানা তৈরি করা যায়। কিন্তু ইন্টারনেটে ডিভাইসের সংখ্যা এত বেড়ে গেছে যে এই ঠিকানা প্রায় শেষ হয়ে গেছে। তাই IPv6 চালু করা হয়েছে, যেখানে প্রায় ৩৪০ ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ঠিকানা তৈরি করা সম্ভব!
আমরা যখন ব্রাউজারে cyberdeveloperbd.com লিখি, তখন কম্পিউটার বোঝে না এটা কোথায়। তখন সে DNS (Domain Name System) নামের একটি বিশাল ফোনবুকের মতো সিস্টেমের কাছে যায়।
DNS-এর কাজ খুব সহজ:
এই পুরো প্রক্রিয়াটি হয় মিলিসেকেন্ডের মধ্যে। তাই আমরা কখনো বুঝতেও পারি না যে পর্দার পিছনে এত কিছু ঘটছে।
এখন আসি মূল প্রশ্নে—ডোমেইন নেমের গাণিতিক রূপ কী? উত্তর: আইপি ঠিকানা।
একটি IPv4 ঠিকানা ৩২ বিটের হয়। এটিকে ৪টি অংশে ভাগ করা হয়। প্রতিটি অংশকে বলা হয় অক্টেট (কারণ প্রতিটি অংশ ৮ বিটের)।
উদাহরণ: 192.168.1.1
যেমন: 142.250.190.78 এটিকে বাইনারিতে লিখলে হয়: 10001110.11111010.10111110.01001110
IPv6 অনেক বড়। ১২৮ বিটের। এটিকে ৮টি গ্রুপে ভাগ করা হয়। প্রতিটি গ্রুপ ৪টি হেক্সাডেসিমাল সংখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
উদাহরণ: 2607:f8b0:4004:0831:0000:0000:0000:200e
কম্পিউটারের জন্য শুধু সংখ্যাই ভাষা। তাই ডোমেইন নেমকে আইপি ঠিকানায় রূপান্তর করা ছাড়া ইন্টারনেট কাজ করতে পারে না।
ধরুন, আপনি আপনার মোবাইলে cyberdeveloperbd.com খুললেন। কী হয় পর্দার পিছনে?
১. আপনার ফোন DNS-এর কাছে জানতে চায় cyberdeveloperbd.com-এর আইপি ২. DNS উত্তর দেয়: ১৪৬.১১২.৬১.১০০ ৩. আপনার ফোন সরাসরি সেই আইপি ঠিকানায় সংযোগ স্থাপন করে ৪. সার্ভার থেকে ওয়েবপেজের ডেটা এসে আপনার সামনে দেখায় প্রথম আলোর হোমপেজ
আপনি যদি সরাসরি ব্রাউজারে আইপি ঠিকানা লেখেন (যেমন: http://142.250.190.78), তাহলেও গুগল খুলবে! কারণ ডোমেইন নেম ছাড়াই আইপি দিয়ে সরাসরি সার্ভারে পৌঁছানো যায়।
আবার, আপনার বাসার Wi-Fi রাউটারের আইপি সাধারণত 192.168.0.1 বা 192.168.1.1 হয়। এটা একটা প্রাইভেট আইপি। বাইরের ইন্টারনেটে আপনার একটা পাবলিক আইপি থাকে, যেটা আপনার ISP দেয়।
ডোমেইন নেম হলো মানুষের জন্য সুন্দর নাম, আর আইপি ঠিকানা হলো তার গাণিতিক রূপ—ইন্টারনেটের প্রকৃত ঠিকানা। DNS নামের একটি অসাধারণ সিস্টেম এই দুটোর মধ্যে সেতুবন্ধন তৈরি করে।
মূল কথা যা আপনার মনে রাখা উচিত:
আগামী কয়েক বছরের মধ্যে IPv6 সম্পূর্ণরূপে প্রতিস্থাপন করবে IPv4-কে। তখন আমাদের আইপি ঠিকানাগুলো আরো লম্বা এবং জটিল দেখাবে, কিন্তু DNS-এর জাদুতে আমরা কখনো সেটা বুঝতেও পারব না।। এই দীর্ঘ যাত্রার শেষে আমরা যেটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পারলাম তা হলো: ডোমেইন নেম আর আইপি ঠিকানা আসলে একই জিনিসের দুটো মুখ মাত্র। একটা মুখ মানুষের জন্য—সহজ, সুন্দর, মনে রাখার মতো। আরেকটা মুখ কম্পিউটারের জন্য—শুধুই সংখ্যা, শুধুই গণিত, শুধুই ০ আর ১-এর জগৎ।
আমরা যখন ব্রাউজারে google.com, facebook.com বা prothomalo.com লিখি, তখন আমরা আসলে একটা মিথ্যে বলি না—কিন্তু সত্যিটা লুকিয়ে রাখি। সত্যিটা হলো, আমরা যাচ্ছি ১৪২.২৫০.১৯০.৭৮ বা ২৬০৭:f8b0:4004:831::200e-এর মতো একটা গাণিতিক ঠিকানায়। DNS নামের একটা অদৃশ্য, অতি দ্রুতগতির “অনুবাদক” আমাদের এই মিথ্যেটাকে সত্যিতে রূপান্তরিত করে দেয় মিলিসেকেন্ডেরও কম সময়ে। এই অনুবাদ ছাড়া আধুনিক ইন্টারনেট কল্পনা করা যায় না।
আজকে আমরা যে IPv4 ব্যবহার করি, সেটার জন্ম ১৯৮১ সালে। তখন কেউ ভাবেনি যে একদিন প্রতিটি ফ্রিজ, গাড়ি, লাইট বাল্ব, এমনকি গরুর গলায় থাকা সেন্সরেরও আলাদা আইপি ঠিকানা লাগবে। কিন্তু সেই দিন এসে গেছে। তাই IPv4-এর ৪৩০ কোটি ঠিকানা ফুরিয়ে গেছে। এখন আমরা ধীরে ধীরে IPv6-এর দিকে যাচ্ছি—যেখানে ঠিকানার সংখ্যা এত বেশি যে পৃথিবীর প্রতিটি বালির কণাকে বিলিয়ন বিলিয়ন আইপি দেওয়া যাবে, তবুও শেষ হবে না।
তাই বলা যায়, আইপি ঠিকানা শুধু একটা সংখ্যা নয়—এটা ইন্টারনেটের হৃদয়। আর ডোমেইন নেম হলো সেই হৃদয়ের ওপরে পরানো একটা সুন্দর মুখোশ—যাতে আমরা, সাধারণ মানুষ, ভয় না পাই।
আপনি যতদিন bangladesh.gov.bd বা rokomari.com লিখবেন, ততদিন পর্দার পিছনে আইপি ঠিকানা আর DNS নিঃশব্দে কাজ করে যাবে। আপনি যতদিন ইন্টারনেট ব্যবহার করবেন, ততদিন আপনি আসলে গণিতের ভাষায় কথা বলবেন—শুধু জানবেন না।
এই অদৃশ্য গাণিতিক জগৎটাই আজকের ইন্টারনেটকে এত শক্তিশালী, এত দ্রুত আর এত বিশাল করে তুলেছে। আর এই জগৎটা বোঝার পর থেকে যখনই আপনি কোনো ওয়েবসাইট খুলবেন, তখন একটু হলেও মনে পড়বে— আপনি শুধু একটা নাম লেখেননি, আপনি আসলে একটা গাণিতিক ঠিকানায় পা রেখেছেন।
ইন্টারনেটের এই নিঃশব্দ বিপ্লব চলতেই থাকবে। আর আমরা শুধু উপভোগ করবো—জেনে বা না-জেনে।